রাঙামাটি প্রতিনিধি: রাঙামাটি শহরে পাহাড় কাটার মহৎসব চলছে। প্রাকৃতিক পাহাড় কেটে উজাড় করা হচ্ছে। দেখার ও আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার কেউ নেই। রাঙামাটি জেলার রাঙ্গাপানি এলাকার লুম্বিনী বিহার সংলগ্ন সাধানপুরে সবুজপাহাড় বলতে আর কিছুই নেই।পাহাড় কাটার শুরুতে প্রতিবেদক ঘটনাস্থল থেকে বিষয়টি জেলা প্রশাসনের ডিপুটি কালেক্টর (এনডিসি)কে মুঠোফোনে অবগত করেছি ।পরবর্তীতে পাহাড় কাটা বন্ধ না হওয়ায় সরাসরি জেলা প্রশাসনের কার্য্যলয়ে গিয়ে এনডিসি বোরহান উদ্দীন মিঠু মৌখিক অভিযোগ করা হয়েছে । সেই সময় তিনি বলেন,বিষয়টি নিয়ে আমি দেখছি কি করা যায়।
দীর্ঘ ১০/১৫ দিন ধরে ২টি( ট্যাক্টর) মাটি কাটার মেশিন দিয়ে রাত ৮টার পর পাহাড় কাটার কাজ করতে দেখা গেছে । আশে-পাশে লোকজন পাহাড়া দিয়ে থাকে এবং প্রতিবেদক সিএনজি যোগে ঘটনাক্রমে রাতে মাটি কাটাস্থলে গিয়ে কাউকে দেখা যায়নি।
রাঙামাটির পরিবেশবাদী সংগঠন গ্লোবাল ভিলেজের নির্বাহী পরিচালক ফজলে এলাহী প্রতিবেদকে বলেন, পাহাড় কাটার কারণে ভূমিধসের ঝুঁকি থাকে। পাহাড় কাটার বিরূপ প্রভাব সম্পর্কে রাঙামাটিবাসী ২০১৭ সালে দেখেছেন। তবুও পার্বত্য এলাকায় পাহাড় কাটা থেমে নেই। কখনো সরকারি, কখনো ব্যক্তি মালিকানাধীন কাজে পাহাড় ধ্বংস চলছে। পরিবেশকে বাঁচাতে স্থানীয় প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদফতরে ভূমিকা রাখতে হবে।
পরিবেশ বিধ্বংসী নানা কর্মকান্ডে মধ্যে পাহাড় কাটা বিশেষ আলোচনার শীর্ষে। পাহাড় কাটার মাধ্যমে ভূমির রক্ষার ভূমিকাকে অকেজো করে দেয়া হয়। ফলে পাহাড় নিজেই দুর্বল হয়ে ধসে পড়ে। নদ-নদী, গাছপালার মতোই পাহাড় পরিবেশ-প্রতিবেশের এক বিশেষ অনুষঙ্গ, যার বিনাশ বিশ্বকে নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে ঠেলে দেয়। বর্ষা মৌসুম এলেই দেশে পাহাড় কাটার ধুম পড়ে যায়। এখন আর সেটি কোনো নির্দিষ্ট মৌসুমে সীমাবদ্ধ নেই।
সারাদেশে পাহাড় কাটার বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার সংবাদ প্রকাশিত হলেও রাঙামাটিতে পাহাড় কাটা ও দখল নিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে । এই কারনে প্রকৃতির ভারসাম্য হুমকির মুখে। পাহাড় কেটে ভূমি সমতল করে কাটা পাহাড়ের গায়ে গড়ে তোলা হয় হাজার হাজার অবৈধ বাড়িঘর। পাহাড় কাটা বন্ধে উচ্চ আদালত অসংখ্যবার নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এর পরও অবিরাম আবাসন আর শিল্পায়ন প্রকল্পের কারণে পাহাড় নিশ্চিহ্ন হচ্ছে।
অপরিণামদর্শী পাহাড় কাটায় ভূতাত্ত্বিক গঠন ক্রমে দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে। পাহাড় ধ্বংস হওয়ার ফলে কীভাবে পাহাড় ধস দুর্যোগ আকারে হাজির হয় তা আমরা দেখেছি। এ দুর্যোগে প্রাণ ও সম্পদহানি ঘটে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত এক দশকে পাহাড় ধসে দুই শতাধিকের বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। পাহাড়ের অধিকাংশ অংশই মানুষ দখল ও দুষন প্রতিযোগিতাই নেমেছে । অথচ পৃথিবীর অনেক দেশে উঁচু পাহাড় অক্ষত রেখে ঢালু জায়গায় গড়ে তোলা হয়েছে অনিন্দ্যসুন্দর জনপদ।
২০১৭ সালে ১৩ জুন পাহাড় ধসে প্রাণহানি-ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে প্রশাসনের কিছু সতর্কতামূলক তত্পরতা দেখা গেলেও পাহাড় ধস ঠেকানোর ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন তথা কারো কোনো প্রচেষ্টাই নেই। শুধু প্রাকৃতিক কারণেই পাহাড় ধসে পড়ছে তা কিন্তু নয়। নিয়ন্ত্রণহীন পাহাড় কাটা, পাহাড়ে স্থাপনা নির্মাণসহ আরো কিছু অপরিণামদর্শী মনুষ্য তত্পরতার পরিণামে ধসে পড়ছে পাহাড়। এক্ষেত্রে ব্যবস্থা গ্রহণ ও আইন প্রয়োগে প্রশাসনের উদাসীনতা কাম্য নয়। প্রশাসনকেও জবাবদিহিতার আওতায় আনা হোক।
অত্যান্ত দু:খের বিষয়, কিছু মানুষের লোভ-লালসার শিকার হয়ে প্রকৃতির এই অসামান্য দান ও সম্পদ বিনষ্ট করে পরিবেশকে হুমকির মুখে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকার খবরে প্রকাশ, আন্তর্জাতিক ভূতত্ত্ববিদরা গভীর আগ্রহ নিয়ে বাংলাদেশে এসে বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকা পরিদর্শন করে পাহাড়-টিলা কাটার নমুনা দেখে হতবাক হয়ে যান।
১৯৮৩ সালে সরকার পাহাড়-টিলা কাটার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। পরবর্তীকালে ১৯৮৭ সালের সংশোধিত আইনের আওতায় অনুমতি সাপেক্ষে পাহাড় ছাঁটার অনুমোদনের ব্যবস্থা রাখা হয়। কিন্তু আইনের ফাঁক দিয়ে টিলা ছাঁটার নামে বড় বড় টিলা কেটে সমতল করা হচ্ছে। এটা দেখার বা বাধা যাদের পক্ষ থেকে দেয়ার কথা, তারা অর্থের লোভে এ কাটায় সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। বাস্তবে দেখা গেছে, কোথাও টিলা বা পাহাড় কাটার খবর আইন-শৃঙ্খলা প্রয়োগকারী সংস্থাকে জানানো হলে তারা হয়তো তদন্তে যায়, কিন্তু তাদের যাওয়ার আগেই টিলা বা পাহাড় কাটার খবর জড়িতদের জানিয়ে দেয়া হয়।
পাহাড় কাটা হয়ে গেলে পরে এ আইনে মামলা দিয়ে শান্তি বিধানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু পাহাড় কাটা রোধ করার কোনো কার্যকর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আইনে নেই। পাহাড় ও বন কাটার সঙ্গে জড়িত শ্রমিকদের মাঝেমধ্যে গ্রেফতার করা হচ্ছে। কিন্তু মূল হোতারা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে বা পরিবেশ আদালতে মামলা করেই যেন পরিবেশ অধিদপ্তরের দায়িত্ব শেষ। একথা ভুলে গেলে চলবে না যে আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা এবং পাহাড় ধ্বংসকারীদের আইনানুগ শান্তি নিশ্চিত করার দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের। সাম্প্রতিক সময়ে যেসব আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে, সেগুলোয় একই অপরাধ বারবার হলে শাস্তির মাত্রা কয়েক গুণ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। পরিবেশ আইনে যদি এমন দুর্বলতা থাকে, তাহলে তা দূর করা এবং আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। প্রয়োজনে শাস্তির মাত্রা বাড়িয়ে পরিবেশ ধ্বংসকারী দুর্বৃত্তদের নিবৃত্ত করতে হবে।
পাহাড়ের মালিকানা ভূমি মন্ত্রণালয়ের। বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় বনজ সম্পদ রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত। পাহাড় এলাকায় বাড়িঘর নির্মাণের নিয়ন্ত্রণ পূর্ত মন্ত্রণালয়ের ওপর ন্যস্ত। এদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা সুযোগ করে দিয়েছে নির্বিচারে পাহাড় কাটা, পাহাড়ের গায়ে বেড়ে ওঠা গাছপালা উজাড় করে দালানকোঠা, বস্তি নির্মাণের ক্ষেত্র। পাহাড় কাটা, পাহাড় কেটে অবৈধ বাড়িঘর নির্মাণ পরিবেশ সংরক্ষণ বিধি ১৯৯৫-এর ১৫ ধারার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এবং এর জন্য রয়েছে শাস্তির বিধান। তবে পাহাড়খেকোদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। তাই পাহাড় কাটা, বসতি স্থাপনও থেমে থাকেনি।
ক্ষুদ্র ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থ যেখানে কাজ করে, সেখানে শুধু নীতিবাক্য আর সদাচরণের মৌখিক আহ্বান কোনো কাজে আসে না। এজন্য নীতি ও নিয়মের পাশাপাশি কঠোর আইনের প্রয়োজন। সে আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং আইন প্রয়োগে সংশ্লিষ্ট সব মহলের সততা, নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও দেশপ্রেমের দরকার। যারা পাহাড় কাটছে এবং পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে, এসব ব্যর্থতার দায় শুধু তাদের নয়। এর দায় স্থানীয় প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোরই বেশি। নিয়ন্ত্রণমূলক কর্মকান্ড জোরদার করার ক্ষেত্রে কী ধরনের সমস্যা এবং কারা এসবের পেছনে সক্রিয় রয়েছে—এ বিষয়গুলো ভালোভাবে খতিয়ে দেখে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। জননিরাপত্তা, পাহাড়ের সৌন্দর্য ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করা অপরিহার্য।